ফিন্যান্সিয়াল ডিজিটালাইজেশন— ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে সামগ্রিক আর্থিক ইকো সিস্টেমে যে পদ্ধতিগত রূপান্তর ঘটেছে, তা বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন প্রচেষ্টার অন্যতম অনুঘটক হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জি চমত্কার একটি তথ্য তুলে ধরেছে। তারা বলছে, আর্থিক প্রযুক্তির বর্ধিত ও বহুমাত্রিক ব্যবহারের মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলো ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষভাবে উৎপাদশীলতা বৃদ্ধি ও বৃহত্তর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি উল্লেখ্য।
কিন্তু ডিজিটালাইজেশনের অঙ্গীকারগুলো যদি পূর্ণতা লাভ করে, তাহলে পরবর্তীতে টেকসই উন্নয়নের ফল অর্জনের জন্য আমাদের করণীয় হচ্ছে দৃঢ়ভাবে আর্থিক ও বিনিয়োগ কৌশলগুলোর পুনর্বিন্যাস। এমন জটিল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়ালের ওপর একটি টাস্কফোর্স গঠনের জন্য সভা আহ্বান করেন। আন্তর্জাতিক এ উদ্যোগে অংশগ্রহণ করে আমরা সম্মানিত বোধ করছি।
সুস্পষ্টভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যারিস এগ্রিমেন্টে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পূরণের জন্য অর্থায়নই একমাত্র চাবিকাঠি। তবে টেকসই উন্নয়নের জন্য যে পরিমাণ আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন, বিশ্বের কাছে সঞ্চিত অর্থের মজুদ এর চেয়ে অনেক বেশি বা সন্তোষজনক হলেও অন্তর্বর্তীমূলক চাহিদা ও সরবরাহ ব্যর্থতার ফলে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা যতদূর সম্ভব ব্যর্থতায় পর্যবসিত। এর মধ্যে যেসব দেশ টেকসই আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সফলতা অর্জন করেছে, তা তাদের চাহিদার সমানুপাতিক নয় কিংবা চাহিদার তুলনায় কম।
অনেক ফ্যাক্টর আছে, যেগুলো টেকসই উন্নয়নের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকটের শুরুটা হয় ২০০৮ সালে। পরবর্তীকালে নিয়ন্ত্রক ও নীতিনির্ধারকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়াগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি ও আয়সমতাকে প্রভাবিত করেছে। তবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মতো স্পর্ধাজনক পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, এ ধরনের উদ্যোগ অনুরূপভাবেই অবকাঠামো বিনিয়োগের জন্য অনেক নতুন তহবিল সৃষ্টি করতে পারে। একই সঙ্গে যেকোনো একটি জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক নীতি এটাও নির্ধারণ করতে পারে যে, অর্থায়নের প্রক্রিয়াগুলো কি আমাদের টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে নাকি উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে কিংবা এর গতিপথ পাল্টে দেয়?
কিন্তু মোবাইল সংযোগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্য সংগ্রহ, ব্লক চেইন ও ইন্টারনেটের বিভিন্ন বিষয়ের মতো প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত নতুন ব্যবসায়িক মডেলগুলোর শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশন দীর্ঘমেয়াদে বৃহত্তম পার্থক্য ঘটাতে সক্ষম। এ অসীম সম্ভাবনা যা-ই হোক না কেন, এটি কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। চূড়ান্তরূপে টেকসই উন্নয়নের ওপর ডিজিটালাইজেশনের প্রভাবগুলো নির্ভর করবে দ্রুততর বিশ্লেষণ ও অত্যধিক সস্তা তথ্যের আগমনের ওপর, যা বর্তমানের সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
শোভন উন্নয়ন ফলাফলের জন্য আর্থিক প্রযুক্তি কিন্তু নাগরিকদের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে। যেমন কেনিয়ার ডিজিটাল বিপ্লব সেখানকার দরিদ্র পরিবারগুলোকে সৌরবিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সরকারি বন্ড মার্কেটসহ অন্যান্য জায়গায় অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের অ্যাবানড্যান্স, জামার্নির ইকোক্রাউড ও জাপানের এনপিওব্যাংকের মতো ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মগুলো এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ও ঋণ বিষয়ক টেকসই সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে। চীনের অ্যান্ট ফরেস্ট প্লাটফর্ম ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট (মানুষ পরিবেশকে কতটা ব্যবহার করছে, তার পরিমাণ) হ্রাসে সহযোগিতা করেছে। অ্যাপের মাধ্যমে বাইসাইকেল শেয়ারিং সার্ভিস ব্যবহার এবং ডিজিটালি অর্থ প্রদানের সুবিধা বিশ্বের বিভিন্ন শহরের লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ফলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি এটি তাদের জন্য বিকল্প একটি স্বাস্থ্যকর পরিবহন ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছে।
সংক্ষেপে বললে, আর্থিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য ডিজিটাল বিপ্লবের যে শক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে, এরই মধ্যে তার ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি। লেনদেনের পাশাপাশি বিনিয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটছে, আর্থিক ব্যবস্থায় মানুষের প্রবেশাধিকার পক্ষপাতহীন হয়েছে বা আরো স্পষ্টভাবে বললে গণতন্ত্রীকরণ ঘটেছে। বিষয়গুলো অপরিহার্যভাবে বৃহৎ উন্নয়নকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে। জাতিসংঘের উন্নয়ন তহবিল অনুসারে, কোনো ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাব নেই, এমন ব্যক্তি থেকে শুরু করে সবার জন্য এসডিজি অর্জনের প্রথম আটটি মানদণ্ডের একটি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন।
এ অবস্থায় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পদ্ধতিগতভাবে চিন্তা করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা; টেকসই উন্নয়নের জন্য ডিজিটালাইজেশন কীভাবে আর্থিক ব্যবস্থাকে বিন্যাস করতে সক্ষম, তা বোঝার জন্য খুচরা স্তরের উদাহরণগুলোর তথ্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূল্য বিচার করা যেতে পারে; যেমন বিনিয়োগকারীরা কীভাবে ঝুঁকি চিহ্নিত করেন, তা বিশ্লেষণ ও ঝুঁকির মাত্রাকে হ্রাস করতে পারে কিংবা কীভাবে ক্যাপিটাল মার্কেটের পরিবর্তন ঘটে আর নীতিনির্ধারক ও ব্যবস্থাপকরা কীভাবে তাদের কাজগুলো সম্পাদন করেন।
তবে এখানে সমস্যাটা হলো, বেশির ভাগ সমাধানই অসম্পূর্ণ ও সংকীর্ণ কিংবা স্বল্প পরিসরে সংজ্ঞায়িত। তাছাড়া যতক্ষণ পর্যন্ত এটি বিশ্বমানবতার জন্য বড় ধরনের কোনো বাহ্যিক হুমকি তৈরি না করছে, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন— বর্তমানে এ ইস্যুটি বেশির ভাগ আর্থিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া এখনো টেকসই তহবিল অবকাঠামোর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়গুলোর সংযোগ ঘটেনি। অবৈধ আর্থিক প্রবাহ উন্নয়নের উৎসগুলোকে নিঃশেষিত করছে। তবে ফিনটেক রেভল্যুশন বা আর্থিক প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মধ্যে জীববৈচিত্র্যের জন্য টেকসই অর্থায়ন কার্যত উপেক্ষিত। এমনকি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি— ফিনটেক এক্ষেত্রে বৃহত্তম উন্নয়নকে প্রভাবিত করতে সমর্থ হলেও দরিদ্র ও বৈষম্য হ্রাসে এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া বাকি।
এখানে কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করছি, যা নিয়ে আমাদের গঠিত টাস্কফোর্স কাজ করবে। আমাদের সদস্য হিসেবে রয়েছেন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণকারী, পুঁজিবাজারের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানরা। ২০১৯ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করব। আমাদের কর্মতালিকার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সমস্যা বিশ্লেষণ, সম্ভাবনা চিহ্নিতকরণ ও আর্থিক ডিজিটালাইজেশনের রূপান্তর বিষয়ক সুপারিশ তৈরি করা, যার মাধ্যমে পৃথিবী ও এর বাসিন্দাদের উপকার সাধনের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি নাগাদ আমরা আমাদের কাজ শুরু করব এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপস্থাপন করব আমাদের গবেষণার প্রাথমিক সেট। এভাবেই আমরা আমাদের কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।
গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়টির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদানের সময় উল্লেখ করেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি গেম চেঞ্জারের ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব ও নীতি নির্দেশিকার সাহায্যে আর্থিক ডিজিটালাইজেশন নাগরিকদের ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে বাস্তব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ আকৃতি গঠনে ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের এখন সম্ভাবনাটিকে কাজে লাগানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের পথ ত্বরান্বিত হয়।
[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ২০১৮]
লেখকদ্বয় যথাক্রমে অ্যাবসা গ্রুপ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ও ইউএনডিপির প্রশাসক
ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস